হার্টের সমস্যার লক্ষণ ও প্রতিকার


 

হার্ট অ্যাটাক কি?

হার্টের উপরিভাগে লেপ্টে থাকে এক ধরনের করোনারি আর্টারি বা ধমনী, যার মাধ্যমে হার্ট অক্সিজেন  পুষ্টি পায়।যখন  করোনারি আর্টারি বা ধমনীতে চর্বি জামে রক্ত জমাট বেঁধে (শতকরা100ভাগরক্তনালীর রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয় তখন উক্ত রক্তনালীর মাধ্যমে হার্টের যে অংশটুকুতে পুষ্টি এবং অক্সিজেন পেত সেই মাংসপেশিতে নানা রকম পরিবর্তন ঘটতে থাকে, যাকে সাধারনত আমরা বলে থাকি  হার্ট অ্যাটাক। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।

 

সাধারণত হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ করে হয়ে থাকে, কিন্তু এটি করোনারি  ধমনীতে ধমনীতে পরিবর্তনের কারণে চলমান প্রক্রিয়ার কারণে রোগ বহিঃপ্রকাশ  পায়, এজন্য  এই মারাত্মক রোগকে কখনো কখনো নিঃশব্দ ঘাতক বলা হয়। তবে যদি সময় মত রোগ নির্ণয় করা হয় এবং নিয়মিত চিকিৎসকের চিকিৎসায় থাকে তবে নতুন জীবন পেতে পারে।

 

হার্ট অ্যাটাক কেন হয়?

হৃৎপিণ্ড বুকের মাঝখানে বা পাশের কিছু অংশ জুড়ে থাকে,এটি প্রসারণ সংকোচন এর মাধ্যমে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এর কাজ করে থাকে। শরীরে  হার্ট   একটি মাত্র অঙ্গ যেটি সব সময় কাজ করে,কোন সময়ে বিশ্রাম নেয় না।

সবসময় হার্টের কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় পুষ্টি অক্সিজেনের এবং এই পুষ্টি অক্সিজেন সরবরাহের জন্য  হার্টের রয়েছে নিজস্ব রক্তনালী,সাধারণত তিনটে রক্তনালী হার্টের শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে রক্ত  সরবরাহ করে হার্টের মাংসপেশিতে।  এই তিনটি রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মানুষের।

এক নীরব ঘাতক হলো হার্ট অ্যাটাক। যে কোন মানুষ যে কোন সময় এর স্বীকার হতে পারে,বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারন গুলোর মধ্যে একটি হলো হার্ট অ্যাটাক কারণ শরীরচর্চা না করা, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং জীবনযাপনের অনিয়ম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি মারাত্মক আকারে বাড়ায়। এর লক্ষণ গুলো জানা থাকলে একটি জীবন হয়তো বাঁচানো সম্ভব। বিশ্বে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হার্ট অ্যাটাক বা  হৃদরোগ।

 

হার্ট অ্যাটাক কিভাবে হয়?

হার্টে তিনটি রক্তনালীর মধ্যে যেকোনো একটি যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় তখন হার্ট অ্যাটাক হয় কিন্তু রক্তনালী যদি ধীরে ধীরে অনেক দিন ধরে বন্ধ হয়ে যায় তবে হার্ট অ্যাটাক নাও হতে পারে, তবে যদি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই হার্ট অ্যাটাক হবে।


অনেকের  শরীর বিভিন্ন রক্তনালীতে চর্বি জমে থাকে এবং রক্তনালী  সরু বা সোজা হতে থাকে এবং এর ফলে বিভিন্ন  অঙ্গে রক্ত সরবরাহ কমতে থাকে।হঠাৎ করেই রক্তনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে কি না, তা সব সময় নির্ভর করে রক্ত নালীর মধ্যে জমে থাকা চর্বি ভেতরের দিকে যে ধরনের আবরণ থাকে তার  আচরণের ওপর।

 

ভেতরের দিকের আবরণ যদি ফেটে যায় তবে সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালীর সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় হার্টের মাংসপেশি নষ্ট করতে থাকে এভাবেই হার্ট অ্যাটাক হয়, কিন্তু যদি   8 ঘন্টার ভিতরে রক্তনালী খুলে দেওয়া  সম্ভব হয় তবে  হার্টের মাংসপেশিকে রক্ষা করা যাবে।

রক্তনালীর ওপরের আবরণ ফেটে যাওয়ার জন্য গবেষণায় বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়ে থাকে।

যেমন

1।অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার  পরপরই শারীরিক পরিশ্রম করা।

2 একসাথে অতিরিক্ত ধূমপান করা।

3 অতিরিক্ত মাত্রায় দুশ্চিন্তা করা।

4 নিদ্রাহীনতায় থাকা।

5।শরীরের যেকোনো ধরনের ইনফেকশন হওয়ায়।

6 হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ায় বা রেগে যাওয়ায়।

 

হার্ট অ্যাটাকের  লক্ষণ

1।বুকে ব্যথা: সাধারণত বুকের মাঝখানে অনেক বেশি ব্যথা অনুভূত হয় এবং ধীরে ধীরে সে ব্যথা চোয়ালে বাম হাতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।বেশিরভাগ সময় বুকের মাঝখানে চাপ বোধ হয় হার্ট অ্যাটাকের সময়  যা কয়েক মিনিটের বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকে,আবার কিছুক্ষণের জন্য ব্যথাটি চলে যায় আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে এবং ভিতরে একটা অস্বস্তিকর ঝাকুনি চাপ অনুভব হয়।

2 দম ফুরিয়ে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট হওয়া: যদি একটি মানুষের শ্বাসকষ্ট বা অন্য যে কোন সমস্যা না থাকে, তবে যদি হঠাৎ করে শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয় তবে সেটি খুবই খারাপ লক্ষণ।  সাধারনত হূদরোগ থেকে ফুসফুসে পানি জমা সহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে ঠান্ডার সমস্যা না থাকলেও শ্বাস নেওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে,বিশেষ করে খুব অল্প সময়ে দম বা শ্বাস ফুরিয়ে যাওয়া এবং মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়াও হার্ট অ্যাটাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।


3।শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া:শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ কেননা বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা ছাড়াও শরিলে অতিরিক্ত ঘাম হয়,বুক ধরফর করেও শরীরে অনেক বেশি খারাপ লাগতে শুরু করে এটিও হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ।

 

4।ঠান্ডা বা কাশি: যদি কারো অনেকদিন যাবত কাশির সমস্যা থাকে তার সঙ্গে কিছুটা ঘোলাটে বা সাদা কফ বের হয়, তবে বুঝতে হবে তার হার্ট ঠিকমতো কাজ করছে না। তবে কাশির সঙ্গে সব সময় হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নাও হতে পারে কিন্তু যদি কফের সঙ্গে প্রতিনিয়ত রক্ত বের হয় তবে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থেকেই যায় এবং ভবিষ্যতে এর থেকে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। 

 

5।তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়া: হার্ট অ্যাটাকের একটি প্রধান লক্ষণ হলো অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া,বুক ধড়ফড় করা,কিছুক্ষণ কাজ করেই অস্থির হয়ে যাওয়া এবং  মাঝেমাঝেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। এছাড়াও অতিরিক্ত কাজের কারণে শরীরের প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে যায় এবং হৃদপিন্ডের  পেশীর মধ্যে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়,যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়।এটি হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ। 

 

6।ঘুম না হওয়া:সাধারণত হঠাৎ করে সাধারণত হঠাৎ করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে শ্বাসকষ্টের কারণে,যার ফলে  হৃৎপিণ্ডের পেশির ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় চাপ সৃষ্টি করে এবং হার্ট অ্যাটাকের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পূর্বে আগে স্লিপ এপনিয়া দেখা দিতে পারে যেটি  হার্ট অ্যাটাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।

এছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে যেমন: উচ্চ রক্তচাপ,ধূমপান,ডায়াবেটিস মানসিক চাপ ইত্যাদি অন্যতম কারণসমূহ।অনেক সময় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেক বেশি থাকলে করোনারি রক্তনালী বন্ধ হয়ে জায়গাটি ব্লক হয়ে যায়।এছাড়াও উপরোক্ত লক্ষণগুলো প্রায় হার্ট অ্যাটাকের কিছু দিয়েন বা কিছু মাস ধরে দেখা দিতে পারে,যখনই উক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিবে তখনই অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যান্ত জরুরী।

 

হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার উপায়

শুধুমাত্র বেশি বয়সের যে হার্টের সমস্যা হয় তা কিন্তু নয় কারণ এখন অনেক কম বয়সীদের মধ্যেও রোগ হচ্ছে। সাধারণত অনিয়মিত জীবনযাপনকে চিকিৎসকরা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হিসেবে দায়ী করছেন, কিন্তু প্রত্যেকেই প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটায় হার্ট অ্যাটাকের থেকে নিজেদেরকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে।চলুন জেনে নেওয়া যাক কি ধরনের পরিবর্তন ঘাটালে নিজেদেরকে হার্ট অ্যাটাকের মত কঠিন রোগের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।


1।পর্যাপ্ত ঘুম দরকার: একজন মানুষকে সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যই দিনে 7 ঘন্টা ঘুমানো জরুরি এবং মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা খুবই দরকার। এছাড়াও নিয়মিত শরীরচর্চার মধ্যে থাকলে রক্ত কণিকা সচল থাকে এবং রাতে ঘুম ভালো হয়।

 

2।রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিক রাখা দরকারশরীরে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় শর্করা থাকলে তা কখনোই ভালো নয়। কারণ ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, তাই শরীরে শর্করার পরিমাণ সঠিক থাকলে ডায়াবেটিসের রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা এমনিতেই কমে যায় এবং যেকোন সুস্থ মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

 

3 প্রতিদিন শরীরচর্চা করতে হবে: হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচার জন্য সব সময় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, কারণ শরীরের ওজন বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এজন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্ট ভালো রাখার জন্য নিয়মিত আধাঘন্টা করে হাঁটতে হবে এবং সপ্তাহে  অন্তত 5 দিন শরীরচর্চা করতে হবে।

 

4।স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে:প্রতিদিনের খাবারে প্রত্যেকের প্রোটিন,কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের পরিমাণ এর মধ্যে সমতা থাকতে হবে  এবং সতেজ শাকসবজি ,ফলমূল খেতে হবে এছাড়াও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যুক্ত মাছ রাখতে হবে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায়। মিষ্টি,লবণ রেডমিট খাওয়া কমিয়ে ফেলতে হবে এবং ধূমপান মদ্যপান থেকে দূরে থাকতে হবে হার্টকে ভালো রাখার জন্য।

 

হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা

হঠাৎ কেউ হার্ট অ্যাটাক করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা  দেওয়া জরুলি।এজন্য প্রয়োজন হার্ট অ্যাটাকের পর খুবই দ্রুত কার্ডিয়াক পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) প্রয়োগ করা।শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যই  না সাধারণ মানুষের জন্য পদ্ধতিটি জেনে রাখা খুবই জরুরী হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। চলুন জেনে নেওয়া  যাক, হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা বা সিপিআর দেওয়ার নিয়ম।

1।প্রথমে রোগীকে চিত করে শোয়ানোর পর শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে এবং পালস আছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

2।যেকোনো একটি হাত প্রসারিত করে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে  তৈরি করতে হবে এবং আঙ্গুলের তালুর উঁচু অংশটি বুকের পাঁজরের নিচের অংশে ঠিক মাঝ বরাবর বসিয়ে প্রতি সেকেন্ডে দুইবার করে জোরে জোরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

3 অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে দুই হাতে যেন হাত না পড়ে, এমন ভাবে চাপ দিতে হবে যেন দের থেকে দুই ইঞ্চি পরিমাণ নিচের দিকে দেবে যায়। 

 

4।এরকম করে 30 বার চাপ দেওয়ার পরে রোগীর কপালে এবং থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটি খুলতে হবে  এরপরে মুখ দিয়ে মুখের ভিতর দুই বার জোরে জোরে শ্বাস দিতে হবে।

আবার সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে 30 বার করে বুকে চাপ দিয়ে দুইবার সাজ দিয়ে যেতে হবে, তবে সকল পদ্ধতি যদি কাজ না করে তবে কয়েক মিনিটের মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে এবং  হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এরকম আরো ভালো ভালো পোস্ট পেতে আমাদের সাইটটি অনুসরণ করে আমাদের সাথে থাকুনধন্যবাদ


আরোও পড়ুনঃ

সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ জ্ঞান

লোভে পাপ পাপে মৃত্যু

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান

বাংলাদেশের প্রথম

এক নজরে বাংলাদেশ

বাংলা ভাষার ইতিহাস

বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ