কালো মেয়ে



আমাদের সভ্য  সমাজে ও একটি কালো মেয়ের গল্প

রাহাত সাহেব সরকারি একজন কর্মকর্তাসেদিন সন্ধ্যেবেলা অফিস শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে একটি রেস্টুরেন্টে যায়।  আজ সারাদিনই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, তাই মানুষ ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বের হচ্ছে না,  বাইরের পরিবেশটা অনেকটাই জনমানব শূন্য।  আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেছে তা খেয়ালই   করেনি কেউ।  ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাহাত সাহেব বললেন মাই গড দশটা বেজে গেছে, আমাকে এখনই বাসায় যেতে হবেনয়তো বাসায় গিয়ে এক ঘন্টা বউয়ের কাছে বকাবকি শুনতে হবে। রাহাত সাহেব উঠলেন কিন্তু বাইরে এসে দেখলেন চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অল্প গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এখনও হচ্ছেগাড়ির জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কোন গাড়ি না পেয়ে রাহাত সাহেব ভাবলেন আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি যায়এখান থেকে  বাড়ি যেতে বড়জোর 30 থেকে 40 মিনিট সময় লাগবে।

রাহাত সাহেব রাস্তার একপাশ ধরে হেঁটে যাচ্ছে আর মনে মনে গুনগুন গান গেয়ে চলেছে একা একা।  কিছু দূর হাঁটার পর হঠাৎ ঝাপটা বাতাসের সাথে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল রাহাত সাহেব দেখলেন সামান্য একটি সামনে একটি যাত্রী ছাউনীরাহাত সাহেব একদৌড়ে যাত্রী ছাউনিতে চলে আসলেন।  এসে দেখলেন যাত্রী ছাউনিতে একজন মেয়ে বসে আছে একা একারাহাত সাহেব মনে মনে যেন একটি প্রফুল্ল হলেন আর ভাবলেন যাক সময়টা তাহলে ভালোই কাটবে। যাত্রী ছাউনী টা ছোট হওয়ায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করছে যার জন্য মেয়েটি যাত্রী ছাউনিতে বসার যে বেঞ্চের ব্যবস্থা ছিল তার ঠিক মাঝখানে বসেছিল।  রাহাত সাহেব অনেক চেষ্টা করে মেয়েটির চেহারা বুঝে উঠতে পারলেন নাকারণ চারিদিকে অন্ধকার বিরাজ করতেছিল।  রাহাত সাহেব মেয়েটির কাছে বেঞ্চে বসার জন্য অনুমতি চাইলেনমেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আর একটু সরে বসলে।  রাহাত সাহেব একটু ইচ্ছে করেই মেয়েটি কাছাকাছি বসলেনতারপর মেয়েটির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলেনবিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন একের পর একমেয়েটি খুব সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছিল, মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে রাহাত সাহেবের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল।  রাহাত সাহেবের কেন জানি মেয়েটির কন্ঠ পরিচিত মনে হল,  কিন্তু ঠিক মনে করতে পারল না,  বাতাসের শন শন শব্দ,  সেইসাথে মুষলধারে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর মেয়েটির খুব একটা কথা বলছে না খুব সংক্ষেপে শুধু উত্তর গুলো দিয়ে যাচ্ছে, তাই  রাহাত সাহেব কন্ঠটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না 


রাহাত সাহেবের মাথায় তখন শুধুই মেয়েটিকে ঘিরে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা ঘুরতেছিল এবং সে ধীরে ধীরে মেয়েটির আরো কাছে ঘেষে বসলোএকপর্যায়ে তার শরীরে একটু দেশ স্পর্শ করলএবং বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো। রাহাত সাহেব বললো আপনার কন্ঠটা কিন্তু ভারী মিষ্টিআপনি দেখতে খুব মিষ্টি।  এবার মেয়েটি প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘায়িত করল বলল, এই অন্ধকারের মাঝেও আপনি আমার চেহারা বুঝে ফেললেন,  কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না,  আমি দেখতে ভীষণ কালো,  আমি  একটি কালো মেয়ে, আপনি কি  কালো মেয়ে  পছন্দ করেনরাহাত  সাহেব একটু সাহস পেয়ে মেয়েটির হাতে হাত  রেখে বলল কালো মেয়ে কোন সমস্যা নাকালো মেয়ে আমার ভীষণ পছন্দ, যেমন কালো চুল,  কাজল কালো চোখতেমনি কালো মেয়ে আমার পছন্দ  আমার বরং ফর্সা  মেয়ে ভালো লাগেনা আমার তো আপনাকে ভীষণ ভালো লেগেছেএক কথায় বলতে গেলে আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর রাহাত সাহেব মেয়েটিকে বললেন চলুন না আজকের সময়টা আমরা উপভোগ করি, কাছে আমার একটি বন্ধুর বাসা আছে এখান থেকে যেতে 5 থেকে 7 মিনিট সময় লাগবে, তারপর বৃষ্টি থেমে গেলে কাল ভোরে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো। এই যা কত কথা বলে ফেললাম অথচ আপনার নামটা জানা হল না, আচ্ছা আপনার নামটা যেন কি? মেয়েটি রাহাত  সাহেবের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আস্তে করে বললবললো আমার নাম রুপা।  এবার রাহাত সাহেবের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, শরীরটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসলো, রাহাত সাহেব একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। 

আমরা একটু দুই বছর পিছনে ফিরে যাই...

রাহাত সাহেব ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের খুব আদরের সন্তানবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাহাত সাহেব রং নাম্বারে  একটি মেয়ের সাথে কথা বলে  এবং তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক  করে। এক সপ্তাহ পরে তারা দেখাকরে, প্রথম দেখার পর রাহাত সাহেব একটু বিচলিত হলেও মেয়েটিকে বলে তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, আমি তোমাকে ভালোবাসি কারণ তোমার একটি সুন্দর মন রয়েছেআমি কোন বাহ্যিক সৌন্দর্য কে গুরুত্ব দিতে চায় না বরং মানুষের ভিতরে মনুষ্যত্ব তাকে দেখতে চাই।  যাই হোক তাদের সম্পর্ক এক বছর, দুই বছর, তিন বছর পেরিয়ে যায়। এরমধ্যে রাহাত সাহেব মেয়েটির সাথে নিয়মিত দেখা করতো এবং তাকে বিয়ের  আশ্বাস দিত। কিন্তু রাহাত সাহেবের বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করে একটি  সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরেই মেয়েটির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। মেয়েটি শত চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে পরিবারের মাধ্যমে তাদের বিয়ের কথা বলে।  রাহাত সাহেব দুই পরিবারের সবার সামনে মেয়েটিকে অপমান করে এবং বলে আমি কোন কালো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবোনা, কালো মেয়ে আমার মোটেও পছন্দ না। মেয়েটি বলে তাহলে এতদিন যে আমাকে বিয়ের কথা বলতে, আমাকে ভালবাসার কথা বলতে, সেগুলো কি মিথ্যে ছিল। রাহাত সাহেব একগাল হেসে  নিয়ে বললেন কালো মেয়ের  সাথে আবার ভালোবাসা হয় নাকিযা হয় সেটা তো শুধুই প্রেম,  সময় কাটানো। যাই হোক এরপর আর কোনদিন মেয়েটি রাহাত সাহেবের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা  পড়েনিরাহাত সাহেব তার কিছুদিন পরেই বিয়ে করেছেন, ফর্সা সুন্দরী এক রমণীকে ঘরের বউ করে এনেছেনতাদের ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে এসেছে।  কিন্তু কালো মেয়েটি আর বিয়ে করেনিসে চিন্তা করেছে সে আর জীবনে কখনো বিয়ে করবে না।  

রাহাত সাহেবের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভালোবাসা, সেই কালো মেয়েটি আজকের যাত্রী ছাউনিতে বসে থাকা  রুপা। তাই রুপা নামটি শুনেই রাহাত সাহেব যেন কেঁপে উঠলেনতার বুকের ভিতরটা ধরফর করতে লাগলো, দীর্ঘক্ষন রাহাত কোন কথা বলতে পারল  না। এরপর ঝড়-বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই রুপা বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালোযাবার সময় বলে গেলকালো মেয়েরাও মানুষ, তাদেরও ভালবাসার মত একটি মন আছে।  কিন্তু আপনাদের মত উঁচুতলারসভ্য সমাজের মানুষ গুলোর মত তারা কখনো সুযোগসন্ধানী হয়না, তারা কখনো মানুষের শরীরকে ভোগ্য বস্তু হিসেবে কল্পনা করে না,  মানুষের শরীর নিয়ে খেলা করে না

আসলে আমাদের সমাজে রাহাত সাহেবদের অভাব নেই, প্রতিটি অলিতে-গলিতে অফিস-আদালতে রাহাত সাহেবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কালো মেয়ে কিংবা কুৎসিত মেয়ে এদের কাছে কোন পার্থক্য নাএদের কাছে পার্থক্য সময়অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে এরা কুৎসিত মেয়ের সাথে একই বিছানায় শুয়ে থাকতে যেমন প্রফুল্লতা বোধ করে বিপরীত দিকে কালো মেয়েদের বিয়ে করতে এরা ঘোরতর বিরোধী।  এদের বিয়ের জন্য চাই সাদা চামড়া সুন্দরী ফর্সা রমণীকিন্তু ঝড়ে রাত্রে যাত্রী ছাউনিতেকিংবা বাসের দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ভিড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা 10 বছরের শিশু থেকে শুরু করে   চল্লিশোর্ধ  মহিলা পর্যন্ত এদের পছন্দের তালিকায় থাকে। সমাজের রাহাত সাহেবরা অফিসের কেবিনে বসে অধঃস্তন মেয়েদের চেয়ার টেনে কাছে বসিয়ে খোশগল্প করতে উন্মুখ হয়ে থাকেকিন্তু জনসম্মুখে সেই অধঃস্তন কে  তুই থেকে তুমি সম্বোধন করতে লজ্জাবোধ করে।  সমাজের রাহাত সাহেবরা কালো মেয়েদের সাথে রাতের আধারে প্রণয় আলাপ করতে যতটা  স্বাচ্ছন্দ্যবোধ  করেদিনের আলোতে তাদের সাথে কথা বলতেও তারা অসম্মান বোধ করে।  প্রত্যেকটি রাহাত সাহেবের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজারো কালো মেয়ের সব হারানোর গল্প।  সমাজে মুখোশধারী রাহাত সাহেবরা যেন কালো মেয়েদের জীবনে আসে এক কালো অধ্যায় হয়েরুপার মতো হাজারো কালো মেয়ে রাহাত সাহেবদের জীবনে শুধুই ভোগ-বিলাসের বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ব্যবহার শেষ হয়ে গেলে তাদের ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় ডাস্টবিনে। 

 

কালো মেয়ের ছবি








আমাদের গল্পটি কেমন লাগে তা অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন এবং এরকম আরো সুন্দর সুন্দর লেখা পেতে আমাদের সাইটটি অনুসরণ করুন।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ